Image of Hind Rajab

হিন্দ রজব; বিশ্বজুড়ে আইডিএফকে তাড়িয়ে বেড়ানো রাজকুমারী

এক;
২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪
ফিলিস্তিনের গাযায় ক্লান্তিকর যুদ্ধ শেষে শীতকালে একটু উষ্ণতার ছোঁয়া নিতে ইউভাল ভাগদানি (Yuval Vagdani) ব্রাজিলে গিয়েছিল। ব্রাজিলিয়ান সুদীর্ঘ, নিটোল ললনা। রোঁদে লুটোপুটি খাওয়া বিচ। হালকা হুইস্কি। জীবনে আর কী চাই! জীবনের সব রং, রূপ, রস একাকার।

কিন্তু বাদ সাধে ব্রাজিলিয়ান আদালত। সবকিছু ভণ্ডুল করে দিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ব্রাজিলের ফেডারেল আদালত ইউভাল ভাগদানির বিরুদ্ধে তদন্তের আদেশ দেয়। অভিযোগ–গাযায় যুদ্ধাপরাধের সাথে সে যুক্ত। এলাকার পর এলাকা, গোটা বসতি অঞ্চল ডিনামাইট মেরে উড়িয়ে দিয়েছে সে। সেগুলো আবার নিজেই নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপুল আনন্দে শেয়ার করেছে।

বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খী, আত্মীয়স্বজন–সবাই বাহবা জানিয়েছে। গ্রেট জব, ব্রাভো! ওয়েল ডান। গো এহেড। লাইক, শেয়ার, কমেন্ট আর বীরত্বের দুয়োধ্বনিতে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব। যেসব ইজরাইলি সরাসরি ফিলিস্তিন গণহত্যায় অংশ নিতে পারেনি, তারা প্রতিকী গণহত্যার মিম বানিয়ে অংশ নিয়েছে।

জয়জয়কার আর দুয়োধ্বনিতে ভেসে যাওয়া সেসব পোস্ট যে ব্রাজিলে এভাবে তাড়া করে বেড়াবে, ইউভাল দুঃস্বপ্নেও তা ভাবেনি।

কোনোমতে সে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও বিধিবাম। আগে থেকেই সেখানে দুজন আইনজীবি ঠিক করা ছিল। তারা ইউভালসহ আরও কয়েকজন ইজরাইলি সেনার বিরুদ্ধে মামলা করে। ইজরাইলি পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সক্রিয় হয়ে উঠে। ইজরাইলের সুবিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ককেও এক্টিভ করা হয়। যেকোনো মূল্যে ইউভালকে আর্জেন্টিনা থেকে বের করে আনতে হবে।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি হয়ে ইজরাইলে গিয়ে পৌঁছে। জানায়–আর জীবনে কোনোদিন ব্রাজিলে যাবে না। গণহত্যায় অংশগ্রহণের প্রমাণ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও করবে না।

এই পুরো ঘটনার পিছনে রয়েছে ‘হিন্দ রজব ফাউন্ডেশন’ নামে বেলজিয়ামের একটি এনজিও।

দুই;
ফিলিস্তিনের গাযা শহরের পশ্চিম প্রান্তে তেল আল হাওয়া। ২০২৪ সালের ২ জানুয়ারি আইডিএফ গাজা শহরে অভিযান শুরু করে। প্রাণ বাঁচাতে শহরের অধিবাসীরা ঘরবাড়ি ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। পুরো শহর পরিণত হয় ভূতের নগরিতে। অভিযান বিস্তৃত হতে হতে গাযার উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। একসময় তেল আল হাওয়াতেও এর আঁচ লাগে।

সেদিন ছিল ২৯ জানুয়ারি। ইজরাইলি বাহিনির গণহত্যা থেকে বাঁচতে ছোট্ট একটা পরিবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছিল। গাট্টিবোচকা গুছিয়ে, অনির্দিষ্টকালের জন্য অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়াতে যাচ্ছে। গাড়িতে ছিল দুরন্ত, ছোট্ট, ফুটফুটে ফিলিস্তিনি মেয়ে হিন্দ রজব। বয়স মাত্র ৬ বছর। তার মা আগেই এলাকা ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে চলে গেছে।

Tal al hawa map; ফিলিস্তিনের মানচিত্র
তেল আল হাওয়া ও গাজার মানচিত্র

শরণার্থী শিবিরের কষ্টক্লেশ ছোট্ট হিন্দ সইতে পারবে না বলে মা তাকে রেখে গিয়েছিলেন চাচার বাসায়। কিন্তু শহর যখন মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়, চাচার পরিবারও শহর ছেড়ে চলে যেতে মনস্থ করে। দুপুরের ঠিক পরপরই তারা বেরিয়ে পড়েন। ছোট্ট প্রাইভেট কারে আরও ৫ জনের সাথে গাদাগাদি করে হিন্দ বসা ছিল।

পেট্রোল পাম্পে তেল নিতে থামতেই, দুপুর ৩ টা ৩১ মিনিটে ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (পিআরসিএস) থেকে ফোন আসে। ফোনটা তুলে হিন্দের চাচাত বোন, ১৫ বছর বয়েসী লায়ান হামাদেহ। রেড ক্রিসেন্টের কলটা এসেছিল পশ্চিম তীর থেকে। পশ্চিম তীরে একটা কল এসেছিল জার্মানি থেকে। আর জার্মানিতে একটা কল বা মেসেজ গিয়েছিল গাড়িতে থাকা চাচার কাছ থেকে।

দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে পশ্চিম তীর থেকে রেড ক্রিসেন্টের রানা ফাকিহ যখন কল দিয়েছে, ততক্ষণে গাড়ির সবাই মৃত। লায়ান আর হিন্দ বাদে।

রেড ক্রিসেন্টের সাথে লায়ানের কথা হয়েছে খুবই অল্প সময়। লায়ান জাস্ট বলতে পেরেছিল–আমাদের দিকে ট্যাঙ্ক আসছে! ট্যাঙ্ক আসছে!

মাত্র ৬ সেকেন্ডে ৬৪ টা গুলির শব্দ। একটানা। তীব্র। কান ফাটানো। তারপর সব সুনসান। লায়ান চিরকালের জন্য হারিয়ে যান নৈশব্দের জগতে।

কিছুক্ষণ পর পশ্চিম তীর থেকে আবারও কল করা হয়। এবার কলটা রিসিভ করে ছোট্ট হিন্দ। গাড়িতে ৫ টা লাশ। রক্তে মাখামাখি। পেছনের সিটে লুকিয়ে বেঁচে আছে ৬ বছরের হিন্দ।

কল ধরে তার একই কথা–“আমাদের দিকে ট্যাঙ্ক আসছে। আমাকে বাঁচাও। আমাকে বাঁচাতে আসো। তুমি কি আমাকে বাঁচাতে আসবে? বলো আসবে?”

ওপার থেকে রানা ফাকিহ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। সুরা ফাতিহা পড়াচ্ছিলেন। আর বলছিলেন কিচ্ছু হবে না মা। আমি আসছি। কলটা ৩ ঘণ্টা ধরে এক্টিভ ছিল। অবশেষে কেটে যায়।

ছোট্ট হিন্দ যদিও জানে না, কিন্তু ফাকিহ জানে যেসব এলাকায় ইজরাইলি ট্যাঙ্ক কিংবা সৈন্য মোতায়েন থাকে, সেখানে সব ধরনের গাড়ি, এম্বুলেন্স, ডাক্তার, নার্স, উদ্ধারকারী–যেকোনো কিছু যাওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। দেখামাত্রই গুলি। তাই ফাকিহ ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে আইডিএফের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। হিন্দকে বাঁচাতে এম্বুলেন্স পাঠাতে।

এই যোগাযোগে কোনো কাজ হয়নি। উমর তারপর ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নিয়ে সরাসরি আইডিএফের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। ৩ ঘণ্টা দেনদরবারের পর এম্বুলেন্স পাঠানোর অনুমতি মেলে। তৎক্ষণাৎ গাজা থেকে একটি এম্বুলেন্স রওনা দেয়। ইউসুফ যেইনো এবং আহমেদ আল মাযহু ছিল এম্বুলেন্সে। ফিলিং স্টেশনের কাছে পৌঁছে তারা হিন্দদের ক্ষতবিক্ষত গাড়িটি দেখতে পান। পশ্চিম তীরে রানা ফাকিহের কাছে কল দেওয়া হয়–আমরা গাড়িটি দেখতে পাচ্ছি। ট্যাঙ্কও দেখা যাচ্ছে। গুলির শব্দ আসছে।

ওপার থেকে জিজ্ঞেস করা হল–এম্বুলেন্সের লাইট অন আছে? সাইরেন বাজছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, লাইট অন আছে। কিন্তু সাইরেন কাজ করছে না।
আচ্ছা, ধীরে ধীরে…
ঠিক তখনই গুলির শব্দ তীব্রতর হয়। লাইন কেটে যায়।

ওপাশ থেকে রানা ফাকিহ নিজেকে সান্ত্বনা দেন–হয়ত তারা হিন্দকে খুঁজে পেয়েছে। হয়ত তার সেবা করছে। তাই কল ধরছে না।

তারপর একে একে কেটে যায় টানা ১২ দিন। কারো সাথে কারো যোগাযোগ নেই। ১২ দিন পর, ১০ ফেব্রুয়ারি ইজরাইলি বাহিনি এলাকা ছেড়ে চলে গেলে হিন্দের মা আসেন।

তিনি দেখতে পান গাড়িতে ছয়জনই মৃত। ছোট্ট হিন্দের শরীরটাও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। এম্বুলেন্সটা পাশেই। পেছন দিকে ট্যাঙ্কের গোলার বিশাল এক গর্ত। ইউসুফ আর আহমেদের নিথর দেহ সেই এম্বুলেন্সের ভেতর। হিন্দকে আর বাঁচানো হয় নি যে।

তিন;
ফিলিস্তিনে সংঘটিত নির্মম এই ঘটনার নিন্দায় হৃদয়বান মানুষেরা সোচ্চার হয়ে উঠে। ইজরাইল তড়িঘড়ি ঘটনার একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে। ‘দীর্ঘ ও নিরপেক্ষ’ তদন্তের পর ইজরাইলের পেশাদার সেনাবাহিনি জানায়–২৯ জানুয়ারি সেই এলাকায় ইজরাইলের কোনো ট্যাঙ্ক উপস্থিত ছিল না। ফলে এখানে এম্বুলেন্সের উপস্থিতিরও কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারা কীভাবে মারা গেছে, ইজরাইল জানে না।

বিভিন্ন দিক থেকে উঠা সমালোচনার স্বর স্তিমিত হয়ে যায়। আমেরিকা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। পৃথিবীর সর্বাধিক নৈতিকতাসম্পন্ন ইজরাইলি সেনাবাহিনি এই যাত্রায় বেঁচে গেল!

কিন্তু সব ভজঘট পাকিয়ে দেয় রেড ক্রসের ফাঁস করা কল রেকর্ড। সুস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে লায়ান এবং হিন্দ–দুইজনই বলছে ট্যাঙ্ক আসছে! ট্যাঙ্ক আসছে!

আল জাযিরা নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ঘটনার তদন্তে নামে। সাথে ছিল ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের মাল্টিডিসিপ্লিনারি গবেষণা সংস্থা ‘ফরেনসিক আর্কিটেকচার’। বিশ্বখ্যাত এই সংস্থা সমস্ত ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করে, ঘটনার থ্রিডি মডেলিং করে নিশ্চিত হয় যে এই হত্যাকাণ্ড ইজরাইলি সেনাবাহিনিই ঘটিয়েছে। এমনকি হিন্দকে হত্যার সময় আইডিএফের ট্যাঙ্ক গাড়ি থেকে মাত্র ১৩ থেকে ২৩ মিটার দূরে ছিল। এটুকু দূরত্ব থেকে ট্যাঙ্কের অপারেটর অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিল গাড়িতে কে কে আছে, কে মৃত আর কে জীবিত। কারণ ট্যাঙ্কের অপটিক সিস্টেমের মাধ্যমে কয়েক কিমি দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।

ইজরাইলি ট্যাঙ্ক, পেট্রোল পাম্প, হিন্দের গাড়ি এবং এম্বুল্যান্সের অবস্থান

স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যাচ্ছে ঘটনার সময় সেখানে একটি নয় বরং তিনটি ইজরাইলি ট্যাঙ্ক উপস্থিত ছিল। তাছাড়া ৬ সেকেন্ডে ৬৪ বুলেট ছোঁড়ার সক্ষমতা একে-৪৭ কিংবা কালাশিনকভের নেই, যা হামাস সদস্যরা ব্যবহার করে। ইজরাইলি সেনাবাহিনির কাছে থাকা এম-৪ ও অন্যান্য মেশিনগানই এত অল্প সময়ে এতবেশি বুলেট ছুঁড়তে পারে। ফলে নিশ্চিতভাবেই এটি ইজরাইলি ট্যাঙ্কের উপর থেকে আসা মেশিনগানের শব্দ। এখানে কোনো ‘গোলাগুলি’ ছিল না। সবগুলো গুলিই ছিল একতরফা।

এম্বুলেন্স থেকে প্রাপ্ত বোমার অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা করে দেখা গেছে এগুলো মেড ইন আমেরিকা। আইডিএফ যেগুলো ইউজ করে। হিন্দ রজবের ছোট্ট গাড়িতে গুলির ছিদ্র ছিল ৩৬৫ টা!

চার;
লেবানিজ মানবাধিকার কর্মী এবং রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট দিয়াব আবু জাহজাহ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে হিন্দ রজব ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেন। হিন্দ রজব ফাউন্ডেশনের মাদার প্রতিষ্ঠান দ্য ৩০ মার্চ মুভমেন্টও তার গড়ে তোলা। সাথে আছে পাকিস্তানি এক্টিভিস্ট হারুন রাজা।

হিন্দ রজব ফাউন্ডেশন গড়ে তোলার উদ্দেশ্য হল–ফিলিস্তিনে ইজরাইলি সৈন্যদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখী করা। তাদের এই কাজ আইডিএফ অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছে। কারণ তাদের প্রতিটি যুদ্ধাপরাধ স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে, অত্যন্ত সোৎসাহে নিজেরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছে।

হিন্দ রজব ফাউন্ডেশনের কাজ হল এগুলো জাস্ট এগুলো সংগ্রহ করে রাখা। তাদের ভলান্টিয়াররা দিনরাত ঘেঁটে প্রায় ৮ হাজারের মত ভিডিও-ইমেজ ডাউনলোড করে রেখেছে। সেগুলোর মেটাডাটাসহ সমস্ত ইনফরমেশন অত্যন্ত যত্নের সাথে সেভ করে রেখেছে। যেসব সৈন্যরা নিজেদের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছে, তাদের নাম-ধাম, ব্রিগেড ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেছে।

তারপর সবগুলো তুলে দিয়েছে আইসিসির হাতে। আইসিসিতে ১ হাজার ইজরাইলি সৈন্যের নামে মামলা করেছে। প্রমাণ হিসেবে এসব সৈন্যদের নিজেদের পোস্ট করা সেসব ভিডিও-ইমেজ দাখিল করা হয়েছে। এই তো গেল বৈশ্বিক পরিসরে। এরপর তৃণমূল থেকে বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি দেশে তাদের সহকর্মী বা প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবীদের নিকট এসব ডকুমেন্টস সরবরাহ করা হয়েছে। হেগে অবস্থিত দশটি দূতাবাসের মাধ্যমে সেসব দেশে ফাইলগুলো পাঠানো হয়েছে।

এখন তারা লক্ষ্য রাখে–কোন আইডিএফ সদস্য কোন দেশে যাচ্ছে। যখন কোনো আইডিএফ সদস্য কোনো দেশে যাওয়ার তথ্য পায়, নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়ায় তা পোস্ট করে। সেই দেশের মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবীদের নিকট সেই সৈন্যের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ সরবরাহ করে তাদেরকে সেখানে মামলা করতে বলে। এমনকি ইজরাইলি সৈন্যদের সাথে যেসব প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গাযা গণহত্যায় অংশ নিয়েছে, তাদের কর্মী, মালিক, শেয়ারহোল্ডারদের নামেও মামলা হচ্ছে।

আইডিএফ যেসব বুলডোজার ইউজ করেছে গাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে, সেগুলো যে প্রতিষ্ঠানের, সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক নিজেই ঘরবাড়ি ধ্বংসের ভিডিও আপলোড করেছে। ইতালিতে বিয়ে খেতে যাওয়ার পর তার নামে সেখানে মামলা হয়। সে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

এক্ষেত্রে বড় সফলতা আসে মরক্কোতে আইডিএফ সদস্য মোশে আভিজারকে গ্রেফতার করার পর (Moshe Avichzer)। গাজায় তার ৩ মাসের সার্ভিসকালে নিজের যুদ্ধাপরাধের ছবি সে নিজেই আপলোড করেছিল। তারপর একের পর এক ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, থাইল্যান্ডসহ ইজরাইলি সৈন্যরা যেখানেই যাচ্ছে, সেখানেই মামলার শিকার হচ্ছে এবং পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।

অবশেষে ইজরাইল সরকার আহবান জানিয়েছে আইডিএফ যেন যুদ্ধাপরাধ ‘পোস্ট’ না করে। এটি হিন্দ রজব ফাউন্ডেশনের কাজ আরও সহজ করে দিয়েছে। সরকারের এই ঘোষণা থেকেই প্রমাণিত হয় তারা ‘যুদ্ধাপরাধ’ বন্ধ করতে আগ্রহী না, এটি তারা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে, ভবিষ্যতেও করবে, জাস্ট সেগুলো পোস্ট করা থেকে বিরত থাকবে।

আইডিএফের ট্যাঙ্কের গোলায় এম্বুল্যান্সে সৃষ্ট গর্ত

পাঁচ;
ছোট্ট হিন্দ রজবের নিথর দেহটা ১২ দিন গাড়িতে পড়ে ছিল। তার আত্মা হয়ত তখন জান্নাতে আরও ৩০ হাজার ফিলিস্তিনি সোনামনির সাথে খেলা করছিল। কিন্তু পৃথিবীতে তার মৃত্যু খোদ ইজরাইলের মৃত্যু ডেকে এনেছে, তা কি সে জানে? পিটপিট চোখে কি হিন্দ এগুলো দেখতে পাচ্ছে?

ইজরাইলের কিছু মৌলিক সংকট আছে। তন্মধ্যে সবচাইতে বড় সংকট হল–জনসংখ্যা সংকট। ইজরাইল কখনোই গ্রেটার ইজরাইলের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবে না, জাস্ট জনসংখ্যার অভাবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ নাগরিক টানতে না পারলে ইজরাইলের অস্তিত্ব টিকে থাকবে না–এটি ইজরাইলের প্রতিষ্ঠাতারা বেশ ভালভাবেই জানত।

তাই তাদের প্রথম এবং প্রধান ফোকাস ছিল কীভাবে সারা দুনিয়া থেকে ইহুদিদেরকে ইজরাইলে জড়ো করা যায়। ফলে ইজরাইলের অধিকাংশ নাগরিক দ্বৈত নাগরিত্বধারী। অর্থাৎ তারা ইজরাইলের নাগরিক, আবার ভিন্ন আরেকটা দেশ, যেটা তাদের প্রকৃত জন্মভূমি, সেটারও নাগরিক। ইজরাইলি আইনে পৃথিবীর সমস্ত ইহুদি জন্মসূত্রেই ইজরাইলের নাগরিক। এইভাবেই ইজরাইল নাগরিকত্ব বাড়িয়ে দেখায়।
ইজরাইলের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ শ্রমিক নেই। কৃষিখামারে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাষী নেই। সেনাবাহিনিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য নেই। সংখ্যার বিচারে নিছক ফিলিস্তিনেই তারা অর্ধেক। গ্রেটার ইজরাইল বাস্তবায়ন করতে গেলে মিশর-জর্ডানের মুসলিম জনসংখ্যার বিচারে ইহুদিরা হবে সংখ্যালঘু। নিতান্ত সংখ্যালঘু।

এই যখন অবস্থা, তখন বলাই বাহুল্য আইডিএফের প্রধান চ্যালেঞ্জ পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য যোগাড় করা। অস্ত্রশস্ত্র, অর্থবিত্ত দেওয়ার জন্য ইজরাইলের পৃষ্ঠপোষকরা বসেই আছে। কিন্তু ম্যানপাওয়ার পাবে কই?

হিন্দ রজব ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম এক্ষেত্রে সরাসরি হুমকি তৈরি করেছে। একে তো বর্তমান আইডিএফ কর্মকর্তাদের ভেতর পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। সৈন্যরা গোটা বিশ্ব থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। হিন্দ রজব ফাউন্ডেশন দেশে দেশে নথিপত্র পাঠাচ্ছে। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে বলে দিচ্ছে এদেরকে যেন ঢুকতে দেওয়া না হয়।

অস্ট্রেলিয়ার মত অত্যন্ত কট্টর প্রো-ইজরাইল রাষ্ট্র ইতোমধ্যেই প্রথমবারের মত ইজরাইলের পক্ষ ত্যাগ করেছে। জাতিসংঘে স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ সমর্থন করেছে। আইডিএফে সেবা দিয়েছে এমন প্রতিটা ব্যক্তি আলাদা ১৩ পৃষ্ঠার ফর্ম ফিলাপ করতে হয়। সে কোনো ধরনের যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় যুক্ত ছিল না, এটি প্রমাণ করতে হয়। অস্ট্রেলিয়াসহ একাধিক দেশ তাদের দেশের ইহুদি নাগরিকরা ইজরাইলে যুদ্ধাপরাধে যুক্ত কিনা–তা তদন্ত শুরু করেছে।

উল্লেখ্য–তুরস্কে বিশাল সংখ্যক দ্বৈত নাগরিকতাধারী ইহুদি থাকলেও উপরের তালিকায় তুরস্কের নাম নেই!

হিন্দ রজব ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম আইডিএফের বর্তমানকে শুধু নয়, বরং ভবিষ্যতকেও হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। হিন্দ রজব ফাউন্ডেশনের ভাষ্য হল–২০২৪ সাল ছিল ইয়ার অব ইম্পিউনিটি বা দায়মুক্তির বছর। সারা দুনিয়ার চোখের সামনে, লাইভ টেলিকাস্টে গণহত্যা চালাচ্ছিল। কেউ যেন মিস করে না যায়, তাই বুক ফুলিয়ে সগর্বে সেই গণহত্যা প্রচার করেছিল। কারণ তারা জানত এই দুনিয়ায় তাদেরকে কেউ কিচ্ছু করার নেই। হিন্দ রজব ফাউন্ডেশনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা–২০২৫ হবে ইয়ার অব পানিশমেন্ট।

রাকিবুল হাসান
তাকমিল; মাদরাসা বাইতুল উলুম, ঢালকানগর
গ্রাজুয়েশন; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২০ জানুয়ারি, ২০২৫

Similar Posts