যেসব কারণে হামাস অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে
অনেকেই ধারণা করছিল হিযবুল্লাহকে দমনের পর হামাসও দমে যাবে। ইরানকে দমনের পর হামাস দমে যাবে। ইজরাইলি সামরিক পরিকল্পনাকারীরা ভাবছিল হামাস নেতাদের মেরে ফেললে হামাস দমে যাবে। কেউ ভাবছে গাজা, রাফাহ, খান ইউনুস সব বিচ্ছিন্ন করে ফেললে হামাস দমে যাবে।
কিন্তু গাজার মত ছোট্ট ভূখণ্ডকে কয়েকডজন পিসে ভাগ করেও হামাসকে দমন করা যায় নাই।
হিযবুল্লাহ ইজরাইলের সাথে অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করার পর অনেককে বলতে দেখেছি-হামাস শেষ। তাদের কেউ কেউ আবার নিজেকে অনেক বড় পন্ডিত মনে করে। এত কনফিডেন্সের সাথে তারা ফেসবুকে বলাবলি করছিল যে হামাস শেষ, যেই কনফিডেন্স হয়ত নেতানিয়াহুরও নাই।
যাইহোক,আমি সবসময়ই বিশ্বাস করছি হামাস পূর্ণশক্তিতে ফিরে আসবে। এবং আপনারা দেখছেন যুদ্ধের শেষদিকে হামাসের আক্রমণ তীব্র হইছে, ভয়াবহ হইছে এবং শক্তিশালী হইছে।

এটা কীভাবে সম্ভব হল?
এই জায়গাটা বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে হামাসের অস্ত্রের উৎস কী? ইরানের সাথে হামাসের কোনো সীমান্ত নাই, ফলে কোনো সংযোগও নাই। হিযবুল্লাহর সাথে হামাসের কোনো সীমান্ত নাই, ফলে হিযবুল্লাহ থেকেও অস্ত্র আসার কোনো সম্ভাবনা নাই। এবং গতকালের (২৪ জানুয়ারি, ২০২৫) আল জাযিরা ডকুমেন্টারিতে বলছে, আর যারা খোজ খবর রাখেন তারা বহু আগে থেকেই জানেন যে হামাসের সমস্ত অস্ত্র মেড ইন গাজা।
হামাসের অস্ত্র কারখানা নিয়ে ডজন ডজন ডকুমেন্টারি আছে। সেখানে ইয়াসিন থেকে শুরু করে স্নাইপার রাইফেল, রাইফেলের গুলি-সবই প্রস্তুত করা হয়।
হামাস বাইরে থেকে শুধু টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ পায়। অস্ত্র পায় না। অস্ত্রের জন্য তাদের মোটামুটি ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের উপর নির্ভর করতে হয়। আর অস্ত্র বানানোর কাজে হামাস উস্তাদ।
২০১৪ সালে ইজরাইলের উপর যে রকেটগুলো নিক্ষেপ করা হইছিল, এগুলো ছিল পানির পাইপ। খোদ ইজরাইলের বসানো। গাজাতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইজরাইলের সরাসরি দখলদারিত্ব ছিল। পশ্চিম তীরের মত গাযাতেও ইজরাইলি বসতি ছিল।
সেসব বসতিতে পানি সরবরাহের জন্য ইজরাইল যেসব পাইপ বসিয়েছিল, ভেকো দিয়ে সেগুলো তুলে হামাস রকেটে রূপান্তর করে খোদ ইজরাইলেই সেগুলো নিক্ষেপ করছে।
ঘরোয়া টেকনোলোজিতে তৈরি দেখেই হামাসের রকেট ও অস্তশস্ত্রের পাওয়ার এত কম। কারণ এগুলোতে খুবই সাধারণ বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়, পরিমাণেও নিতান্ত কম। যার কারণে দেখবেন ইয়াসিন রকেটে, বা মাইন পুঁতে রাখলে এতে ট্যাঙ্ক একদম ছিন্নভিন্ন বা নাস্তানাবুদ হয়ে যেত না। বরং হয়ত চেইন ছিড়ে যেত, নাজল নষ্ট হয়ে যেত।
এগুলোকে রেকার দিয়ে টেনে নিয়ে ইজরাইল পুনরায় মেরামত করত। আর মারকাভা ট্যাঙ্কের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এটা একটা যে-এর পার্টসগুলো সব আলাদা আলাদা। যত পার্টসই নষ্ট হোক, নতুন পার্টস লাগালেই আবার সচল।
পক্ষান্তরে ইজরাইলের বোমাগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার পর দৃশ্য দেখেছেন? মনে হয় মিনি কেয়ামত ঘটে গেছে। ভবনের পর ভবন টুইন টাওয়ারের মত ধ্বসে যায়। পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। বিশাল বড় গর্ত হয়। ওদিকে হামাসের রকেট পড়লে দেয়ালে ফুটো হয়, ছাদের খানিকটা ধ্বসে পড়ে। বাদবাকি জিনিসপত্র ঠিকই থাকে।

কিন্তু এখানে কিছু ব্যতিক্রম আছে। সেটা কী?
যুদ্ধের শেষদিকে, বা গতকালের আল জাযিরার ডকু যারা দেখছেন, তারা দেখেছেন মাইনের আঘাতে মারকাভা একদম মুড়ির টিনে পরিণত হইছে। পুরোটা ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেছে।
হামাসের হাতে এত শক্তিশালী বিস্ফোরক এল কোথেকে? এগুলো আসলে ইজরাইলের নিক্ষিপ্ত অবিস্ফোরিত বোমা। ইজরাইলের বিমান থেকে, ট্যাঙ্ক থেকে যত বোমা বা গোলা নিক্ষেপ করা হয়েছে, তার বিশাল অংশ অবিস্ফোরিত। একাধিক রিপোর্টে দেখা গেছে যুদ্ধের প্রথম দিকে ইজরাইল যত বোমা ফেলেছে, তার ৪০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণহীন ছিল! যখন রিপোর্ট করা হয় তখনো পর্যন্ত গাজায় ৩০ হাজার টন বোমা ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে সাত হাজার টনই অবিস্ফোরিত রয়ে গেছে!
এসব অবিস্ফোরিত বোমার মধ্যে এক টন ওজনের বোমাও রয়েছে! বলাই বাহুল্য এগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী বিস্ফোরকে ঠাসা। আর হামাস যে পরিমাণ বিস্ফোরক ব্যবহার করে, সেই হিসেবে দেখে গেছে এই পরিমাণ অবিস্ফোরিত বোমা থেকে প্রাপ্ত বিস্ফোরক দিয়ে হামাসের আগামী ৫-৭ বছরের গোলাবারুদ হয়ে যাবে।
আরও একটি বিষয় হল ইজরাইলের কঠোর অবরোধের কারণে গাযায় এমনকি ইট-সিমেন্টও ঢুকতে পারে না। এগুলো নাকি হামাস টানেল তৈরিতে ব্যবহার করবে। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে-হামাসের টানেল তো তৈরি হইছে। সেগুলো এতই বিশাল যে সোয়া একবছরেও ইজরাইল সেগুলোর হদিশ খুঁজে বের করতে পারে নাই। পাঁচ-দশতলা ভবনের মত টানেল। মজবুত। শক্তিশালী কংক্রিটের দেয়ালে ঘেরা।
এসব কংক্রিট আদতে ২০১৪ সালের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ ও এর পরের ছোট ছোট আক্রমণে তৈরি ধ্বংস্তুপ থেকে সৃষ্ট সুড়কি দিয়ে তৈরি।
গাযায় তেমন কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নাই। জাস্ট সমুদ্রে মাছ ধরা, টানেল দিয়ে অস্ত্র ও খাবার নিয়ে আসা, আর ইট-সুড়কির ধ্বংস্তুপ থেকে কংক্রিট-রড আলাদা করে সেগুলো হামাসের কাছে বিক্রি করা। অনেকটা আমাদের দেশের ভাঙ্গাড়ির দোকানের মত।

২০১৪ সালের যুদ্ধের পর দেখা গেছে গাযার অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর সবচাইতে বড় ও ব্যাপক ছিল কংক্রিটের মার্কেট। হাজার হাজার মানুষ কংক্রিটের ব্লক তৈরি ও বিক্রিতে লিপ্ত ছিল। ক্রেতা ছিল স্বভাবতই আল কাসসাম ব্রিগেড। যেগুলো দিয়ে তৈরি হইছে তাদের আজকের রহস্যময় টানেল।
তো এখন গাজার কী অবস্থা? ভয়াবহ অবস্থা। গাযার ধ্বংস্তুপ এত বেশি যে হিসাব বলছে এই ধ্বংস্তুপ সরাইতে ২১ বছর লাগবে। যদিও এই ধ্বংসযজ্ঞ কাম্য নয়। কিন্তু যদি যুদ্ধ পুনরায় শুরু না হয়, তাহলে এর আউটকামটা কী হবে বলেন তো? হ্যাঁ, আগামী ২১ বছর হামাসের কংক্রিটের অভাব হবে না।
কারণ নতুন ঘড়বাড়ি নির্মাণের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বা আন্তর্জাতিক দাতাদের তত্ত্বাবধানে ইট-সিমেন্ট রড আসবে। আর পুরো গাজা ঢেকে রাখা এখনকার ধ্বংস্তুপ চলে যাবে মাটির নিচে। সেখানে গড়ে উঠবে আরেক গাজা। মুহাম্মদ দেইফের রহস্যময় প্যারালাল জগত।
এখানেই শেষ না। ভবিষ্যতে হামাসের অস্ত্রশস্ত্রের বিস্ফোরকের কোয়ালিটি কেন আরও অনেক বেশি উন্নত ও শক্তিশালী হবে তা উপরেই বলেছি। পাশপাশি রকেট, রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্রের ম্যাটারিয়ালসগুলোও ওয়ার্ল্ড ক্লাস হবে।
কারণ এখন গাজাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মারকাভা, বুলডোজার, এক্সকাভেটর। যেগুলো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানের ইস্পাত দিয়ে ইজরাইল, আমেরিকা, জার্মানি কিংবা ফ্রান্সে তৈরি। সেগুলো এখন ব্যবহৃত হবে আল কাসসামের অস্ত্রে!
আমি যদি ভুল না করি, তাহলে এখন যুদ্ধ পুনরায় শুরু না হলে পরবর্তী হামাস-ইজরাইল যুদ্ধে আমরা হামাসের ট্যাঙ্কের দেখা পাব। ফর শিউর। কারণ ২০১৪-১৬ সালের দিকেই হামাসের ভিডিওগুলোতে ইজরাইলি ট্যাঙ্কের ডেমো দেখা যে। হামাসের অস্ত্র কারখানায় ট্যাঙ্কের খোলসটা বানানো হইছে। ভেতরে অস্ত্রশস্ত্র নাই।
কিন্তু এখন গাযায় থাকা হালকা ক্ষত, বা প্রায় অক্ষত ট্যাঙ্কগুলোকে হামাস নিঃসন্দেহে মেরামত করবে, সচল করবে। পরবর্তী ৭ অক্টোবর যদি কখনো ঘটে, সেখানে দেখা যাবে গাযা থেকে মারকাভা ঢুকতেছে ইজরাইলে!
অধিকন্তু ইজরাইলের টেকনোলজির এত বেশি পরিমাণ হামাসের হাতে পড়ছে যে ভবিষ্যতে টেকনোলজির জন্য হামাস ইরানের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। ইজরাইল ঘরের ভেতর এসে টেকনোলজি দিয়ে গেছে।
পাশাপাশি আমার পূর্বানুমান হল-হামাস প্রাপ্ত টেকনোলজি, উন্নত স্টিল আর শক্তিশালী বিস্ফোরক দিয়ে এখন গাইডেড মিসাইল তৈরি করবে। ভবিষ্যত রকেটগুলো হয়ত এলোপাতাড়ি এদিক সেদিক না পড়ে সুনির্দিষ্ট টার্গেটে আঘাত হানবে। হতে পারে সেটা নেতানিয়াহুর বাড়ি, হতে পারে ইজরাইলের সংসদ ভবন, কিংবা হতে পারে ঘুমন্ত সেনাপ্রধানের রুম।
লাভা থেকে জন্ম নেওয়া ফিনিক্স পাখির মত ফিলিস্তিনের দুর্বার সৈনিকেরা ধ্বংস্তুপের ভেতর থেকে আকাশ ফুঁড়ে মাথা তুলবে।